Subscribe Us

এনজিও কর্মীর জীবনচক্র (Life Cycle Of NGO Workers)

 আপনি কি এনজিও কর্মী? আপনি কি কেন এনজিও তে জব করতে চাচ্ছেন?  উত্তরটা যদি হ্যা হয়ে থাকে তাহলে লেখাটি সম্পূর্ণ পড়বেন। কারণ আজকে আমি এনজিও কর্মীর জীবনচক্র (Life Cycle of NGO Worker) নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি। 

এনজিও কর্মীর জীবনচক্র (Life Cycle Of NGO Workers) Finance71, NGO

বলা হয়েথাকে যে, এনজিও চাকরী হলো অভিশাপের চাকুরী। নানা রকম অত্যাচার অনাচার সহ্য করার পরও আপনার হাতে যখন আর কোন উপায় না থাকে তখন আপনি এই চাকরী করবেন। তবে সবার ক্ষেত্রে কথাটি সত্য না। কারণ এই সেক্টরে অনেকেই আবার আরামে দিনের পর দিন উদ্ধতনদের পা চেটে দিব্বি চাকরী করছে। তাদের ক্ষেত্রে এ চাকরী আর্শীবাদের চাকরী। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সমস্যা হলো লোন অফিসার/ক্রেডিট অফিসার অর্থাৎ সরাসরি ফিল্ডে যারা কাজ করে। তাই চলুন আগে এদের জীবন টা কিভাবে চলে দেখে আসি।

এনজিওতে সব পালের গোদা অর্থাৎ ডিরেক্টর থেকে শুরু করে নিম্ন লেভেল সবাই সব সময়ই চাপে থাকে এটা আমরা সবাই জানি। এখানে ডিরেক্টর চাপ দেয় জোনাল ম্যানেজারকে, জোনাল ম্যানেজার চাপ দেয় এরিয়া ম্যানেজারদের, এরিয়া ম্যানেজার আবার চাপ দেয় তাদের শাখা ম্যানেজারদের, শাখার ম্যানেজার চাপ দেয় তার কর্মীদের। কিন্তু কর্মীই একমাত্র অসহায় ব্যক্তি যার নিজের কাজ নিজেই করতে হয়। বেচারা যে কাউকে চাপ দিবে তেমন লোক নেই। কর্মী কাজ করে সদস্যদের নিয়ে কিন্তু সদস্যদের বেশি চাপাচাপি করলে কর্মীর কপালেই দুঃখ নেমে আসে। চলুন তাহলে দেখে আসি একজন কর্মীর সারাদিন কেমন কাটে।

এনজিও কর্মীর সারাদিনের কাজঃ

আমরা সাধারণ মানুষ সকাল উঠে ফ্রেশ হয়ে একটু চা নাস্তা খেয়ে খবরের কাজগ পড়ি বা মোবাইল নিয়ে  একটু সময় কাটায়। অন্যদিকে একজন এনজিও কর্মী এসব ঘুম থেকে ওঠার পর মনকে চাঙ্গা করবে এমন কোন কাজই করতে পারে না। কারন তাকে রেডি হয়ে অফিসে হাজিরা দিতে হবে। মনকে রিফ্রেশ করার কোন সময় পায় না বলে এদের মানসিক চাপ দিন দিন বাড়তেই থাকে। গোসল সেরে শার্ট প্যান্ট পড়ে হাজিরা দেয় অফিসে। শুরু হয় কর্মদিবস। শুরু হয় প্লান। ম্যানেজার তাকে জানিয়েছে আপনার সদস্য ভর্তির হার ভালো নয়। যে পরিমাণ সদস্য ভর্তি করার কথা সে পরিমাণ সদস্য আপনি ভর্তি করাতে পারছেন না। এসপ্তাহের মধ্যে তাকে এত পরিমান ঋণ বিতরণ করতে হবে। আদায়ের হার ভালো নয়। আজ একটি কিস্তি ফেলেও অফিসে আসা যাবে না। প্রয়োজনে সন্ধ্যা পর্যন্ত সদস্যর বাড়ি বসে থাকতে হবে ইত্যাদি। গত কাল পর্যন্ত একজনের হাজার ভালো এসিভমেন্ট থাকলেও ওই সব কথা ম্যানেজার ভুলে যাবে। সকালে উঠেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনার জীবনে ভালো কোন কিছু আপনি করতে পারেননি। অফিস থেকে বেরিয়ে সামান্য নাস্তা সেরে  বেরিয়ে গেলেন প্রথম সমিতি কালেকশনে। শুরু হলো অভিশাপের আরেকটি দিন। প্রত্যেকটি সমিতিতে একটি করে সদস্য থাকবেই যে আজকে কিস্তি দিতে পারবে না বলে জানাবে। এসব ভাবলেই ভয় লাগে।

সমিতিতে হাজির হওয়ার পর সব সদস্যর কিস্তি থাকলেও কিছু সদস্যর ফুল কিস্তি থাকবে না। কারো আবার সঞ্চয় থাকবে না। সঞ্চয়ের কথা বললে আবার সে মনে করিয়ে দিতে পারে সঞ্চয়টা আপনার না ওটা সদস্যর। তাই দিবে কি দিবে না সেটা তার ব্যাপার। যাই হোক কালেকশন করার পর দেখা গেলো রহিমা তো আসে নি। করিমন তো গত কিস্তির সাথে এ সপ্তাহের কিস্তি একবারে দেবে বলেছিলো সেও তো আসলোনা। একটা মেয়াদ উত্তীর্ণ সদস্য আছে যে, কোনদিন ও টাকা দেয় না কিন্তু বলেছিলো এসপ্তাহ থেকে নিয়মিত কিছু কিছু দেবে। আরো তো 2-3 টা সমিতি আছে বেলা গড়িয়ে চলেছে। তাড়াতাড়ি এই সদস্যগুলোর কাছে যেতে হবে। 

সমিতি থেকে উঠে আপনি গেলেন রহিমার বাড়ি সে জানিয়ে দিল আজ কিস্তি দিতে পারবে না। বা! কি সুন্দর কথা তার কাছে হয়তো কথাটা সুন্দরই কিন্তু আপনার কাছে একথা খুবই ভয়াবহ। এখন তার সাথে ঝামেলা করতে গেলে আপনার বাকি সমিতি কালেকশনের কি হবে ? আবার ঝামেলা না করেই বা উপায় কি ? এবার গেলেন করিমনের বাড়ি গত সপ্তাহে করিমন কিস্তি না দিয়ে বলেছিল সামনের সপ্তাহে একবারে দিবে। ম্যানেজারের চাপে কিস্তিটা আপনার পকেট থেকে দেওয়া ছিল। তার বাড়ি যাওয়ার পর আপনি দেখলেন সে বাড়িতেই নেই। এর ওর কাছ থেকে তার খবর পেলেন তারপর তার নাগাল পেলেন তারপর সে 10 টাকা 20 টাক করে কুড়িয়ে কুড়িয়ে তাও কিস্তি পুরণ করতে এখনো 45 টাকা বাকি। অবশেষে বলল এই 45 টাকা সামনের সপ্তাহে দিয়ে দেব। তাহলে গত সপ্তাহের টাকা? এই পয়তাল্লিশ টাকার জন্য এই কিস্তিটাও বকেয়া দেখানো যাবে না। তাই এই 45 টাকাও আপনার পকেট থেকেই যাবে। এটা আপনি অবস্যই বুঝতে পারছেন।

তারপর গেলেন মেয়াদ উত্তীর্ণ সদস্যর বাড়ি। এখন থেকে সে নিয়মিত টাকা দেবে 2 বছরের বকেয় টাকা পাওনা আছে তার কছে। গিয়ে দেখলেন সে খুবই ব্যস্ত। আপনাকে চেনার সময় তার এখন নেই। আপনি টাকা দেবে কি না দেবে তাও বলার মতো সময় নেই তার। আপনার তখন মনে হবে। আপনি ফকির আর দয়া চাইতে এসছেন এই বাড়িতে। অথচ যখন তার টাকার দরকার হয়েছিল তখন সে আপনাকে কত আদর আপ্যায়নই না করেছিল তা এখনও মনে আছে আপনার। 

যাই হোক সবগুলো সমিতি কালেকশন করার পর দুপুর পার হয়ে গেলো এ সময় মানুষ একটু খেয়ে দেয়ে ঘুমায়। কিন্তু ওসব আপনার জীবনে নেই। আপনাকে যেতে হবে। একটা সদস্য ভর্তি করতে, একটা লোন ফরম পূরণ করতে। ম্যানেজার ফোন দিয়ে বলেছে আজকে একটা নতুন সদস্য  ভর্তি করাতে হবে, কোথায় পাবেন সেটা তো আর ম্যানেজার জানে না। ভর্তি করার জন্য সদস্যর বাড়ি গিয়ে দেখলেন তাদের যা অবস্থা তার থেকে তাদের লোনের চাহিদা অনেক বেশি। তার লোন দিলে আপনার ঝামেলাপূর্ণ সদস্য সংখ্যা আরো 1  জন বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু আপনার কিছুই করার নেই। কারণ আপনার সদস্য ভর্তি ও ঋণ বিতরণের যে টার্গেট তা পূরণ করতে গেলে এখনো এরকম অরো সদস্য আপনাকে ভর্তি করাতে হবে।

দুপুর গড়িয়ে যখন বিকাল হতে চলেছে তখন আপনি অফিসে হাজির হলেন গিয়ে দেখলেন আপনার দুই জন সদস্য অফিসে বসে আছেন ঋণ নেওয়ার জন্য। কাজের চাপে আপনি এখনো দুপুরে খেতে পারেননি। একন খাওয়ার জন্য গেলে সদস্যরাও আবার বিগড়ে যেতে পারে। তাদের ঋণ দিতে দিতে বিকাল হলো। আপনি কোন রকম কিছু খেয়ে আসলেন না এখন বিশ্রম নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। আপনাকে শিট নিয়ে বেরোতে হবে। বকেয়া সদস্যর সংখ্যা তো অনেক তাদের টাকা আনতে হবে। না হলে মাস শেষে ঐ টাকা আপনার পকেট থেকেই যাবে। এভাবেই সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষুকের মতো আবেদন জানিয়েও বেশিরভাগ সদস্যই টাকা দেয়নি।

অফিসে ফিরতে ফিরতে ততক্ষণ সন্ধ্যা হয়ে গেছে পাখিরা ঘরে ফিরেছে মানুষের কোলাহল ক্ষান্ত হচ্ছে আস্তে আস্তে। কিন্তু আপনি অফিসে এসে দেখেলেন আপনার কাজ এখনও শেষ হয়নি। মিটিং আছে রাতে, অনেক রির্পোট প্রস্তুত করতে হবে, কাল যে সদস্যদের লোন যাবে তাদের কাগজপত্র রেডি করতে হবে, আরো কতো কি ? কাজ শুরু করার আগে একটু বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে তাই দোকানে একটু চা খাওয়াার জন্য গিয়ে ভিষণ একাকিত্ব লাগছে। বাসায় একটু কথা বলা দরকার। বাসায় ফোন দেওয়ার পর ভাবলেন এভাবে আর পারা যাচ্ছে না চাকরীটা ছাড়তে হবে কথাটা আজকে বাসায় বলতে হবে। হটাৎ আপনাকে জানানো হলো টাকা লাগবে। হ্যা টাকা পাঠাতে হবে আপনাকে পরিবারের সবাই আপনার দিকেই তাকিয়ে আছে, কারণ আপনি চাকরী করেন। চাকরীটা ছাড়লে তো আর হবে না। সহকর্মীর ডাকে আবার ফিরতে হবে অফিসে। মনে মনে ভাবছেন এই অভিশাপের জীবন আর কত দিন ? এই প্রশ্নটা হয়তো আপনার একার নয়, প্রশ্নটা হাজার হাজার এনজিও কর্মীর।

মিটিং এ বসে আপনি দেখলেন আপনার এমাসে কিছুই অর্জন করতে পারেননি। সংস্থা অপনাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিচ্ছে। কিন্তু ম্যানেজার জানিয়ে দিলেন আর এ ভাবে চলবে না। টার্গেট পূরণ না করতে পারলে চাকরী ছেড়ে দেন। আপনাদের জন্য তাকে উপরে জবাব দিতে হয়। এই শাখার মতো এতো অগোয্য কর্মী আর কোন শাখাতেই নেই। এরকম হাজারো কটু কথা সহ্য করার পর অবশেষে আপনি একটু সময় পেলেন বিশ্রামের।

হ্যা এতক্ষণে বিশ্রমের সময় হয়েছে। তবে মনে অনেকরকম চিন্তার আর্বিভাব। চাকরীটা এবার থাকবে তো? সকালে আবার শুরু হবে আরো একটা অভিশাপের দিন। 

এভাবেই চলতে থাকে হাজারো এনজিও কর্মীর জীবন। এই কথা গুলো কাউকে বলতে পারে না কাউকে বোঝাতেও পারে না। চাকরী ছেড়ে বাড়ি গিয়েই বা কি করবে? সংসার কিভাবে চলবে? 

প্রিয় বন্ধুরা লেখাটি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করতে পারেন। আর আপনি কোন এনজিও তে কি পদে চাকরী করছেন তা কমেন্ট করে জানাবেন।

আরো পড়ুন:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ